আমার ব্লগ তালিকা

শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০১৫

ইসলামে নান্দনিক শ্রবণীয় শিল্প



ডঃ উসূফ আল কারযাভী



2 Votes

ইসলাম সব সময় সুন্দরের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে থাকে এবং মানুষের সেই ইন্দ্রকে জাগ্রত করতে আগ্রহী যা তাকে বিভিন্ন ভাবে সৌন্দর্য উপভোগ করতে শেখায়।
কিছু কিছু ‘সুন্দর’ শ্রবণইন্দ্রের কাছে ধরা পড়ে, আবার কিছু কিছু ‘সুন্দর’ তার দর্শন ইন্দ্রের কাছে আর কিছু অপরাপর ইন্দ্রের কাছে ধরা পড়ে। এখানে “শ্রবণীয় সুন্দর্য” আলোচনা করা হবে, অর্থাত্ গান সম্পর্কে, হোক বাজনা সহকার আর বাজনা বিহীন।

গান ও বাজনা সম্বন্ধে ইসলামের হুকুম কি?
এটা এমন একটা প্রশ্ন যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে শুনা যায়। এটা এমন একটা প্রশ্ন যার জবাব দানে আজকে সমগ্র মুসলিম জাতি দ্বিধাবিভক্ত। তাদের জবাবের বিভক্তির কারণে তাদের আচার আচরণও বিভিন্ন ধরণের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সব ধরণের গান ও বাজনা কান পেতে শুনে একথা বলে যে, তা হালাল জীবনের অপরাপর হালাল বস্তুর মতো, যা আল্লাহ পাক তার বান্দাদের জন্য হালাল করেছেন।
আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে কোন গানের শব্দ পেলে রেডিও বন্ধ করে দেয় বা নিজের কান বন্ধ করে নেয়। তারা বলে গান হলো শয়তানের বাঁশি ও বেহুদা কথা, যা আল্লাহর যিকির ও নামাজ থেকে বিরত রাখে, বিশেষত গায়ক যদি কোন নারী। কারণ তাদের মত নারীর কণ্ঠস্বর গান ছাড়াই সতরের অন্তর্ভুক্ত, আর যদি তা গানে হয় তাহলে(তা সহজে অনুমেয়)। তারা তাদের এ অভিমতে পক্ষে আলকোরানের কতিপয় আয়াত, কিছু হাদীস ও কিছু আলেমের অভিমত ও উক্তি দ্বারা দলিল দিয়ে থাকেন।
আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে কোন ধরণের বাজনা প্রত্যাখ্যান করেন, এমন কি রেডিও ও টিভির সংবাদের পূর্বে প্রচারিত বাজনা পর্যন্ত।
তৃতীয় আর একদল এই দুইদলের মধ্যে দ্বিধা দন্দ্বে ভোগেন। তারা কখনো একদলের পক্ষে কখনো অন্যদলের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর এরা অবশ্য এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইসলামের আলেমদের কাছ থেকে একটা মনে প্রশান্তি আনয়ণকারী চূড়ান্ত ফায়সালা কামনা করে। যা মানুষের আবেগ অনুভূতি ও দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃ্ক্ত। বিশেষত শ্রবণীয় ও দর্শনীয় প্রচার মাধ্যম মানুষের বাড়ি ঘরে ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় প্রবেশ করার পর, এবং তার গান ও মিউজিক বাধ্য ও অবাধ্য ভাবে তাদের শ্রবণ ইন্দ্রকে আকর্য়ণ করার পর।
বাদ্যযন্ত্র তথা মিউজিকসহ গান ও বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গান এমন একটি বিষয় যা নিয়ে ইসলামের আলেমদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক দীর্ঘ দিন থেকে চলছে।তারা কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্যে উপনিত হয়েছেন আবার কিছু বিষয়ে মতদ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছেন।
তারা ঐক্যমত্যে উপনীত হয়েছেন ঐ সব গান হারাম হবার ব্যাপারে যাতে অশ্লীলতা ও ফাসেকী রয়েছে, এবং যা গুনাহের কাজে উদ্ভুদ্ধ করে। কারণ গানতো মূলত কথাই- তার মধ্যে যা ভালো তা ভালো আর যা মন্দ তা মন্দই। যে সব উক্তিতে হারাম কিছু রয়েছে তাও হারাম। অতএব তার সাথে যদি ছন্দ সূর ও হৃদয়গ্রাহী কিছু থাকে তাহলে তার অবস্থা কিরূপ হবে?(তা সহজে অনুমেয়)।
তেমনি ভাবে তারা আরও ঐক্যমত্যে উপনীত হয়েছেন পূর্বোক্ত বিষয় মুক্ত গান হালাল হবার ব্যাপারে, যা বাদ্যযন্ত্র মুক্ত স্বভাব সূলভ ভাবে অনুত্তেজিত করণার্থে গাওয়া হয়ে থাকে। আর তাও বৈধ আনন্দ বিনোদনের স্থানে। যথা বিয়ের অনুষ্ঠানে, কাউকে স্বাগত জানাবার কালে এবং ঈদের দিন ইত্যাদিতে। তবে শর্ত হলো তাও পর পুরুষের সামনে কোনো নারীর কন্ঠে হওয়া চলবেনা।
এ প্রসঙ্গে কিছু সুস্পষ্ট কুরান ও হাদিসের বাণী রয়েছে যা আমরা পরে উল্লেখ করব।
এছাড়া বাকি গানের ব্যাপারে তারা সুস্পষ্ট মতদ্বন্দ্বে লিপ্ত। তাদের মধ্যে কেউ সব ধরনের গানকে হালাল মনে করেন তা বাদ্যযন্ত্র সহ হোক আর বাদ্যযন্ত্র বিহীন হোক। আর কেউ কেউ সব ধরণের হারাম ঘোষণা করেছেন তা বাদ্য যন্ত্র সহ হোক বা বাদ্য যন্ত্র বিহীন হোক এমন কি তা শুনা পর্যন্ত কবীরা গুনাহ বলেও উল্লেখ করেছেন।
বিষয়টির গুরুত্বের কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। এবং বিভিন্ন দিক থেকে এ প্রসঙ্গে আলোচনা পর্যালোচনা করা আবশ্যক মনে হয়, যাতে মুসলমানেরা এর মধ্য হতে হারাম থেকে হাললকে আলাদা করে নিতে পারেন এবং অকাট্য দলিলের অনুসরণ করতে পারেন। তাদেরকে যেন কারো কথার তাকলীদ বা অন্ধ অনুসরণ করতে না হয়। এর মাধ্যমেই তারা সুস্পষ্ট দলিল নির্ভর এ দ্বীনি বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হতে পারেন।
চলবে…।
মূলত সব কিছু হালাল
ইসলামের আলেমগণ এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মূলত যে কোন বস্তু হালাল। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الأَرْضِ جَمِيعاً
তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত।
He it is Who created for you all that is on earth. ( সূরা আল-বাকারা ঃ ২৯)
কাজেই কোন কিছু সুস্পষ্ট বিশুদ্ধ নাস তথা আল-কুরআন ও সহীহ হাদিস কিংবা নির্ভরযোগ্য প্রমাণীত ইজমা ছাড়া হারাম হতে পারেনা। অতএব কোন নাস (আল-কুরআন ও সহীহ হাদিস) ও ইজমা না থাকলে, অথবা কোন কিছুকে হারাম ঘোষণা করে কোন সুস্পষ্ট নাস আছে কিন্তু তা সহীহ না হলে, কিংবা সহীহ কিন্তু সুস্পষ্ট না হলে সে নাস ঐ বস্তু হালাল হবার ব্যাপারে কোন প্রভাব ফেলবেনা। বস্তুটি বিস্তৃত হালালের গণ্ডিতেই বাকি থাকবে। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُم مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُرِرْتُمْ
অথচ আল্লাহ ঐ সব জন্তুর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলোকে তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।
while He has explained to you in detail what is forbidden to you, except under compulsion of necessity (সূরা আল-আন’আম ১১৯)
আর রাসূল (স)বলেন, যা আল্লাহ তা’আলা তার কিতাবে হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে সব বিষয়ে নিরবতা অবল্বন করেছেন তা মাফকৃত। সুতরাং তোমরা আল্লাহর মাফকৃত বস্তু গ্রহণ করো। কারণ আল্লাহ তা’আলা কোন কিছু ভুলে যাননি। অতপর তিনি তেলাওয়াত করেছেন- نَسِيًّا وَمَا كَانَ رَبُّكَ “সবই তাঁর এবং আপনার পালনকর্তা বিস্মৃত হওয়ার নন। and your Lord is never forgetful, সূরা মারিয়াম ৬৪ । (হাদিসটি হাকেম আবুদ দারদা থেকে বর্ণনা করেন এবং সহীহ বলে মন্তব্য করেন, হাদিসটি বাযযারও বর্ণনা করেছেন।)
তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তা’আলা কিছু কাজ ফরয করে দিয়েছেন তোমরা তা তরক করোনা। আর কিছু ব্যাপারে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তোমরা সে সীমা লংঘন করোনা। আর তোমাদের দয়া পরবশ হয়ে (ভুলে গিয়ে নয়) কিছু বিষয়ে নিরব থেকেছেন সে সব বিষয়ে অনুসন্ধান করোনা।
(দারেকুতনী কর্তৃক আবু সালাবা আল খশনী থেকে বর্ণিত, হাফেজ আবু বকর মোসআলী তার আমানী নামক গ্রন্থে আর নব্বী তার আরবাঈনে হাদিসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন।)
এটাই যদি শরীয়াতের মূলনীতি হয়, তাহলে কোন নাস বা দলিলের ওপর ভিত্তি করে গান হারাম ঘোষণাকারীরা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন ? আর গান বৈধ ঘোষণাকারীদেরই বা এ ব্যাপারে অবস্থান কি ? তা জানা অবশ্যক।

গান হারাম ঘোষণাকারীদের দলিল ও তার পর্যালোচনা
ক. গান হারাম ঘোষণাকারীরা ইবনে মাসউদ ইবনে আব্বাস ও কোন কোন তাবেয়ী থেকে বর্ণিত এক বর্ণনার উপর নির্ভর করেছেন। তারা নিম্নোক্ত আল্লাহ তা’আলার বাণীর উপর ওপর নির্ভর করেই গান হারাম ঘোষণা করেছেনঃ-
وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًا أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِينٌ
একশ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।
And of mankind is he who purchases idle talks to mislead from the Path of Allâh without knowledge, and takes it by way of mockery. For such there will be a humiliating torment (সূরা লোকমান ঃ ৬)
তারা আলোচ্য আয়াতের لَّ عَن سَبِيلِ (লাহুল হাদিস) বা “অবান্তর কথা বার্তা” এর ব্যাখ্যা করেছেন গান বলে।
ইবনে হাযম বলেন, কয়েকটি কারণে এই ব্যাখ্যাটি আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়। ১. রাসুল সাঃ ছাড়া আর কারো কথা হজ্জত বা গ্রহণ যোগ্য নয়। ২. এই ভাবে ব্যাখ্যা কারীরা অপরাপর সাহাবী ও তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার বিরোধীতা করেছেন। ৩. স্বয়ং এই আয়াতের বাক্যাবলী তাদের এ ব্যাখ্যা ও দলিলকে বাতিল করে। কারণ তাতে রয়েছে- “ এক শ্রেণীর মানুষ আছে যে যারা আল্লাহ তাআলার পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথা-বার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে”।

তিনি আরও বলেন, কোন মানুষ যদি আল কোরানও খরিদ করে তার দ্বারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার জন্য এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করার জন্য তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে এইরূপ কর্মের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ কখনো যারা অবান্তর কথা-বার্তা আনন্দ বিনোদন এবং মনে প্রশান্তি আনয়নের জন্য খরিদ করে, আল্লাহর পথকে গোমরাহ করার জন্য খরিদ করেনা। তাই আল্লাহ এখানে তাদের নিন্দা করেন নি। অতএব তাদের আয়াতের ঐ ব্যাখ্যার সাথে আয়াতের কোন সম্পর্ক থাকাটাই বাতিল বলে প্রমাণিত হলো।তেমনি ভাবে যারা কোরান তেলাওয়াতে ব্যস্ত থেকে কিংবা হাদিস অধ্যায়নে ব্যস্ত অথবা কথা-বার্তায় ব্যস্ত থেকে অথবা গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত থেকে কিংবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে নামাজ ছেড়ে দেয় সেও ফাসিক- আল্লাহর নাফরমান। আর যে উপরোক্ত কাজে ব্যস্ত থেকেও কোন ফর্য কাজে গাফেল হয়ে পড়েনা তিনি সত্কর্মশীল । (দলিল- ইবনে হাযম, আল মুহাল্লা, মুনীরিয়া ৯ পৃ.৬০)
খ. তারা মুমিনের প্রশংসায় উল্লেখিত আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা দলিল দিয়েছেন,-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ
আর যখন অনর্থক কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে।
And when they hear Al¬Laghw they withdraw from it and say: (সূরা আল-কিসাস ঃ ৫৫)
তাদের মতে গান যা অনর্থক কথা-বার্তার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তার থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
এ বক্তব্যের জবাবে বলা যায়, এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হলো এখানে লাগভ বা অনর্থক কথা-বার্তা বলতে গালা-গালী ও তিরস্কার জাতীয় মন্দ কথা বুঝানো হয়েছে। আয়াতের বাকি অংশও তাই প্রমাণ করে, আল্লাহ তা’আলা বলেন,-
وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ وَقَالُوا لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ لَا نَبْتَغِي الْجَاهِلِينَ
আর যখন অনর্থক কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে বিমুখ হয়ে যায় এবং বলে, আমাদের জন্যে আমাদের কাজ এবং তোমাদের জন্যে তোমাদের কাজ। তোমাদের প্রতি সালাম। আমরা অজ্ঞদের সাথে জড়িত হতে চাই না।। (সূরা আল-কিসাস ঃ ৫৫)
মূলত আয়াতটি আল্লাহর বান্দাদের প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলার নিম্নোক্ত আয়াতের মতোই,-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا
যখন অজ্ঞরা তাদের সম্বোধন করে তখন তারা বলে তোমাদের প্রতি সালাম ।
when the foolish address them they reply back with mild words of gentleness. (সূরা আল-ফোরকানঃ৬৩)
যদি আমরা ধরে নেই যে, উক্ত আয়াতের লাগভ বা অনর্থক কথা-বার্তা গানকেও শামিল করে তাহলেও আমরা দেখতে পাই যে, আয়াতটি গান শুনা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব বা উত্তম ও প্রশংসনীয় কাজ বলে প্রমাণ করে। গান শুনা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব প্রমাণ করেনা।
“লাগভ” শব্দটি “বাতিল” শব্দের মতোই অনর্থক বেফায়দা বুঝায়, বেফায়দা কিছু শুনা কখনও হারাম নয়, যতক্ষণ না তার কারণে কোন হক বিনষ্ট হয়, কিংবা তা কোন ওয়াজিব কর্ম থেকে বিরত রাখে।
ইবনে জোরাইজ থেকে বর্ণিত যে, তিনি গান শুনা বৈধ মনে করতেন। তাকে জিজ্ঞাস করা হলো, গান কিয়ামত দিবসে আপনার সত্কর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, না কুকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে? তিনি জবাবে বলেন, তা না সত্কর্মের আর না কুকর্মের অন্তর্ভুক্ত হবে, কারণ তাতো অনর্থক বা লাগভ কথারই মতোই। আল্লাহ তা’আলা বলেন,-
لاَ يُؤَاخِذُكُمُ اللّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ
আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে তোমাদের (লাগভ) অনর্থক শপথের জন্যে দায়ী করবেন না।
Allâh will not punish you for what is uninentional in your oaths, (সূরা আল-বাকারা ঃ ২২৪, সূরা আল মায়েদা ঃ ৮৯)
ইমাম গাজ্জালী বলেন, যদি আল্লাহর নামে অর্থহীন শপথ করার কারণে- যাতে দৃঢ় প্রত্যয় ও ইচ্ছা থাকেনা এবং বিরোধিতা করার চিন্তা-ভাবনাও থাকেনা- আল্লাহ তা’আলা দায়ী না করেন তাহলে কি করে ভাবতে পারি যে, কবিতা গাওয়া ও নৃত্যের জন্য দায়ী করবেন। (ইমাম গাজ্জালী, এহইয়াউ উলুমুদ্দিন, মিসর ঃ দারুশ শা’আব, কিতাবুস সিমা, পৃষ্টা ১১৪৭)
চলবে….
.

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০১৫

শিশু রাজন হত্যাঃ দ্রুত দায় দায়ী ও বিচার নিশ্চিৎ করুন।


চুরির শাস্তি কি খুন?
আইনপতিরা (!) জবাব দে!

রাজনের মতো অসহায় ও অবুঝ বালকগুলো আজ চোর কেন? সরকার ও অর্থপতিরা জবাব দে!

আগে একটি ঘটনা শুনুন।
খুব সম্ভব আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রাঃ এর খেলাফতকাল। একজন দোকানের কর্মচারীর উপর চুরির অভিযোগ উঠলো। ইসলামের আঈন খুবই কঠোর। চোরের হাত কেটে দেয়া হবে। খলিফা উমর রাঃ তার বিচার ফায়সালা করবেন। অভিযোককারী দোকানের মালিকের এই বিশ্বাস...

কিন্তু উমর রাঃ সরাসরি বিচারে গেলেন না। তিনি অভিযুক্ত কর্মচারীকে ডেকে পাঠালেন উপযুক্ত তদন্তের জন্যে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযুক্ত কর্মচারী সন্দহাতীতভাবে চোর সাব্যস্ত হলো। তথাপিও উমর রাঃ বিচারে ধিরতা অবলম্বন করলেন। কিন্তু কেন?

তিনি চোরকে একান্তে ডাকলেন। অনেকটা কঠোরতার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যিই কি তুমি চুরি করেছ?

চোরের চেহারায় প্রান্তিক অসহায়ত্য ফুটে উঠলো। কন্ঠে তার বাধভাঙ্গা ব্যাকুলতা। উমরের রাঃ কঠোর শাষণের ভিতির রেখা  তার কপালে প্রতিয়মান। রুক্ষ ও কাঁপা কন্ঠে সে বল্লো, জ্বী হ্যাঁ হুজুর আমি চুরি করেছি। এটা শত ভাগ সত্য...

সততায় অবিচল তার কণ্ঠধ্বণীর পেছনে খলিফার ভাবাবেগ উকি দিলো। তিনি আবার বল্লেন, সত্যিই তুমি চুরি করেছ?
চোরের কন্ঠে সততার একই পাল্টা প্রতিধ্বণি বাঁজলো, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি চুরি করেছি। আমি চোর। আমার বিচার করুন হুজুর। আমার হাত কেটে দিন...

খলিফার ভাবনায় অন্ত এলোনা। চোরের কন্ঠের দ্বিধাহীনতা আর অসহায়ত্বের উচ্ছল ধ্বনি খলিফার ভাবনায় গতির সঞ্চয় করলো। তিনি মায়াভরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা তুমি কেন চুরি করতে গেলে? তোমার নির্ধারিত বেতনেতো তোমার সংসার বেশ কেটে যেত?

এবার চোরের সিক্ত চোখজোড়ার অসহায়ত্ব আরো দ্বীগুণ বেড়ে গিয়ে মাটিতে দাপাদাপি শুরু করলো। পিন্জর ভেঙ্গে পুন্জিভুত দুঃখের একটি দ্বীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কেঁদে ফেল্ল চোর। হুজুর, বেতনে আমার সংসার ঠিকই স্বাচ্ছন্দে কেটে যায়। কিন্তু গত কয়েকমাস আমার মুনিব আমার বেতন আটকে রেখেছে। আমার ঘরের ক্ষুধার্ত সন্তানদের আহাজারি আমি সইতে পারিনি হুজুর। আমার বিবির ছেড়াবস্ত্রে ঢাকা শুকনো মুখ আমাকে ভিষণ আহত করেছে হুজুর। তাই আমি উপায় না পেয়ে চুরি করতে বাধ্য হয়েছি। আমি আমার সন্তানদের জন্য চুরি করেছি। আমার বিচার করুন হুজুর। আমি আমার স্ত্রীর লজ্ঞা নিবিরণের দায়ে চুরি করেছি। আমার হাত কেটে দিন হুজুর... আমার হাত কেটে দিন...

খলিফার চোখে পানি টলমল করতে লাগলো। অসহায় চোরের চোখের পানিযে এক সাগর জলকেও হার মানায়...
তাত্‍ক্ষনিক খলিফা দোকানের মালিককে ডেকে পাঠালেন। ক্ষিপ্তস্বরে ঘোষণা দিলেন, কসম আল্লাহর! এজাতীয় কারণে আর যদি কেউ চুরি করে তবে চোরের আগে আমি মালিকের হাত কেটে দিব...
(চিত্রায়ীত ও সংক্ষেপিত)

সোনালী যুগের এঘটনাটি আমাদের পাঁচটি মূল শিক্ষা দেয়।
এক. চোরের বিচার হবে কিন্তু প্রথমত সঠিক তদন্তে প্রমাণ হওয়া আবশ্যক।
দুই. অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তিও এখানে সতর্কতার সাথে বিবেচ্য।
তিন. বিচার করবে নির্ধারিত দায়ীত্বশীলগণ। যে কেউ নয়।
চার. চুরির সর্বোচ্চ বিচার পর্যায়ক্রমে হাত-পা কর্তণ। খুন নয়।
পাঁচ. সংঘটিত চুরির দায় ও দায়ী চিন্থিত করে সে ব্যাপারে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়াও সমভাবে জরুরী।

এবার আসুন। রাজনের বিষয়টি আমরা একটু খতিয়ে দেখি।
¤রাজন যে চুরি করেছে তাকি আদৌ প্রমানিত হয়েছে? অবশ্যই না।
¤ অভিযুক্ত রাজনের স্বীকারোক্তির কি সামান্যতম মুল্যায়ণ করা হয়েছে? অবশ্যই না। সেতো বরাবরই আমৃত্যু চিত্‍কার করে বলেছে আমি চুরি করিনি... আমি চুরি করিনি...
¤ চুরির বিচার করবে প্রশাসন (যদি প্রমানিত হয়) তাহলে ঘাতকগোষ্ঠীকে আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার দিলো কে?
¤ চুরির প্রাথমিক সর্বোচ্চ শাস্তি হাত কাটা (যদি প্রমাণিত হয়) তাহলে রাজনকে খুন করার অধিকার কে কোথায় পেলো?
¤ সর্বোপরি ধরেই নিলাম রাজন চুরি করেছে যদি করে থাকে। এসব অসহায় গরীবশ্রেণীর অবুঝ  শিশুরা পেটের দায়ে যদি চুরির মতো অপরাধে লিপ্ত হয় তবে এর দায় কার? এর জন্য দায়ী কে? অর্থপতিরা জবাব দে? সরকার জবাব দে?

যদি জবাব না থাকে তবে শোন! আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলি, নিশ্চয় এটি একটি বিচারবহির্ভুত নির্মম হত্যাকান্ড। অনতিবিলম্বে হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ বিচার করা হোক। যদি অভিযুক্তরা পাড় পেয়ে যায় তবে শেষ কথাতো এটাই বলতে হয়, এ হত্যাকান্ডের একমাত্র দায় ও দায়ী সরকার। তাই জনতার আদালতে সর্বশেষ এ সরকারেরই ফাঁসী কার্যকর করা ইসলামের দাবী...

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০১৫

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলাম


 ড. মানে‘ ইবন হাম্মাদ আল-জুহানী
অনুবাদ : মুহাম্মদ নূরুল্লাহ তারীফ
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
Secularism শব্দের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে- ধর্মহীনতা। তবে বাংলা ভাষায় শব্দটির অনুবাদ তা না করে করা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা। বস্তুত এ মতবাদটি ধর্মকে এড়িয়ে নিছক বস্তুবাদী স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মানববিদ্যা ও বুদ্ধির ভিত্তিতে মানবজীবন প্রতিষ্ঠার প্রতি আহ্বান করে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি বলতে বুঝানো হয় – ধর্মের প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ মতবাদটি ১৭শত শতাব্দীতে ইউরোপে আত্মপ্রকাশ করে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি প্রাচ্যে প্রসারিত হয়। প্রথমদিকে মিসর, তুরস্ক, ইরান, লেবানন, সিরিয়াতে প্রসার লাভ করে। ধীরে ধীরে তিউনিশিয়াতে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ইরাকে প্রসারিত হয়। এছাড়া বিংশ শতাব্দীতে এসে অন্যান্য আরব দেশগুলোতেও বিস্তার লাভ করে।
আরব বিশ্বে এই মতবাদকে বুঝাতে ‘লা-দ্বীনিয়্যাহ্‌’ (لا دينية) বা ‘ধর্মহীনতা’ বলার কথা থাকলেও এ মতবাদের প্রবর্তকরা সে শব্দটির পরিবর্তে ‘ইলমানিয়্যাহ্‌’ (علمانية) বা ‘বিজ্ঞানময়’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। প্রথম দৃষ্টিতে কারও কারও মতে হতে পারে যে শব্দটি বোধ হয় ‘ইলম’ তথা ‘জ্ঞান’ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। বস্তুত বিষয়টি এ রকম নয়। এ মতবাদের সাথে বিজ্ঞান বা Science এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা এ শব্দটি ব্যবহারে বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করে; কারণ শব্দটিকে জ্ঞানের দিকে সম্পর্কযুক্ত করতে পারলে আরব সমাজে অপেক্ষাকৃত কম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। তাই এ বিভ্রান্তির নিরসনার্থে শব্দটিকে আরবীতে ‘ইলমানিয়্যাহ্‌’ উচ্চারণ না করে ‘আলামানিয়্যাহ’ বলা উচিত।
আমরা আগেই বলেছি যে, এ মতবাদের উৎপত্তিস্থলে তার জন্য Secularism শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যার অর্থ হচ্ছে ধর্মহীনতা বা ধর্মের সাথে সম্পর্কহীন। কিন্তু বাংলাভাষাভাষি মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এর একটি ভুল অনুবাদ করা হয়ে থাকে, আর বলা হয় যে, এর অর্থ, ধর্মনিরপেক্ষতা।
আমরা এ প্রবন্ধে এটাকে এ প্রচলিত অর্থেই বর্ণনা করব। পাঠকগণ অবশ্যই সেটাকে তার আসল অর্থে বুঝে নিবেন।
Secularism যাকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা হয়ে থাকে, তার সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় ও সমাজিক জীবন থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। ধর্ম ব্যক্তির অন্তরের খাঁচায় বন্দি থাকবে। ধর্মের পরিধি ব্যক্তি ও তার উপাস্যের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। ধর্মকে প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকলে সেটা শুধুমাত্র উপাসনাতে এবং বিবাহ ও মৃত্যু সংক্রান্ত রসম-রেওয়াজে।
রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে খ্রিস্টান ধর্মের মিল রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা থাকবে কায়সার (খ্রিস্টান সরকার প্রধানের উপাধি) এর হাতে, আর গির্জার ক্ষমতা থাকবে আল্লাহর হাতে। যীশুর নামে প্রচারিত বাণী ‘‘কায়সারের অধিকার কায়সারকে দাও এবং আল্লাহর অধিকার আল্লাহকে দাও’’ থেকেও এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। কিন্তু ইসলাম এ ধরনের দ্বিমুখী নীতির অনুমোদন করে না। মুসলিম নিজেও আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তার গোটা জীবনও আল্লাহর জন্য। কুরআনে কারীমে এসেছে
‘‘হে রাসূল! আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।’’[সূরা আন‘আম: ১৬২]
ধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি ও উল্লেখযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বঃ
  • এই মতবাদটি প্রথমে ইউরোপে প্রসার লাভ করে। তারপর প্রাশ্চাত্যের উপনিবেশ শাসন ও কমিউনিজমের প্রভাব-প্রতিপত্তির সুবাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লবের আগে ও পরের বেশকিছু পরিস্থিতি ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক প্রসার ঘটায় এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ও চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। নিম্নে উল্লেখিত ক্রমধারায় ঘটনাগুলো ঘটেছেঃ
  • এক্লিরোস, বৈরাগ্যবাদ, ঐশ্বরিক নৈশভোজ (Holy Communion), ক্ষমাপত্র (Indulgence) বিক্রি ইত্যাদির আড়ালে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণ তাগুতী শক্তি, পেশাদার রাজনীতিবিদ ও স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছিল।
  • গির্জাগুলোর বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অবস্থান, মানুষের চিন্তাধারার উপর গির্জার একচ্ছত্র আধিপত্য, গির্জা কর্তৃক Inquisition কোর্ট গঠন করা এবং বিজ্ঞানীদেরকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্তকরণ। উদাহরণতঃ-
    • কোপার্নিকাস (Copernicus) : ১৫৪৩ সালে ‘‘আকাশে গ্রহ নক্ষত্রের আবর্তন’’ নামক একটি বই প্রকাশ করেন। গির্জা কর্তৃক বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।
    • গ্যালিলিও (Galileo): টেলিস্কোপ আবিস্কার করার কারণে ৭০ বছর বয়সী এই বিজ্ঞানীর ওপর কঠোর নির্যাতন নেমে আসে। ১৬৪২ সালে তিনি মারা যান।
    • স্পিনোজা (Spinoza): তিনি ইতিহাস সমালোচনার প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর শেষ পরিণতি হয়েছিল তরবারীর আঘাতে মৃত্যুদণ্ড।
    • জন লক (John Lock) : তিনি দাবী উত্থাপন করেছিলেন যে, স্ববিরোধিতা পাওয়া গেলে ঐশীবাণীর বিপক্ষে বিবেকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
  • বিবেকবুদ্ধি ও প্রকৃতি নীতির উদ্ভবঃধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিবর্গ বিবেকের মুক্তির দাবী তোলেন এবং প্রকৃতিকে উপাস্যের বিশেষণে বিশেষিত করার দাবী জানান।
  • ফরাসি বিপ্লবঃ গীর্জা ও নতুন এ আন্দোলনের মাঝে দ্বন্দের ফলে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে একটি সরকার গঠিত হয়। জনগণের শাসনের নামে এটাই ছিল প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। কেউ কেউ মনে করেন যে, ফ্রিমেশন (Freemasons) এর সদস্যরা গির্জা ও ফরাসি সরকারের ত্রুটিগুলোকে পুঁজি করে বিদ্রোহ ঘটায় এবং যতদূর সম্ভব তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার প্রয়াস চালায়। এ বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গ্রন্থ ও প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে,
    •  জঁ-জাক রুশো (Jean Jacques Rousseau) মৃত্যু ১৭৭৮ খ্রিঃ – Social Contract (সামাজিক চুক্তি, অনুবাদ: ননীমাধব চৌধুরী) নামে তাঁর একটি গ্রন্থ রয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটি ইঞ্জিলের মর্যাদায় ছিল।
    •  মনটাসকিউ (Montesquieu) এর রচিত গ্রন্থ The Spirit of Laws.
    • ইহুদী ধর্মাবলম্বী স্পিনোজা (Spinoza) কে ধর্মনিরপেক্ষতার পথিকৃত মনে করা হয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে জীবন ও আচার আচরণের পদ্ধতি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ইশ্বরতত্ত্ব ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর রচিত একটি পুস্তিকা রয়েছে।
    •  প্রাকৃতিক আইনের প্রবক্তা ভলটেয়ার (Voltaire): তাঁর রচিত বই হচ্ছে- ‘‘বিবেকের গন্ডিতে ধর্ম’’ (১৮০৪ খ্রিঃ)।
    • উইলিয়াম গডউইন (William Godwin) (১৭৯৩খ্রিঃ): তাঁর রচিত গ্রন্থ হচ্ছে- Political Justice (রাজনৈতিক ন্যায়পরায়নতা)। এই গ্রন্থে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে তাঁর আহবান সুস্পষ্ট।
    • মিরাবোঁ (Mirabeau): যাঁকে ফরাসি বিপ্লবের প্রবক্তা, নেতা ও দার্শনিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
    • বাস্তিল (Bastille) ধ্বংস করার দাবী নিয়ে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে তাদের শ্লোগান ছিল- ‘‘রুটি চাই’’। পরবর্তীতে এ শ্লোগান ‘‘স্বাধীনতা, সম অধিকার ও ভ্রাতৃত্ব’’ তে পরিবর্তিত হয়। এটি মূলতঃ ফ্রিমেশন এর শ্লোগান। তাদের আরেকটি শ্লোগান ছিল ‘‘পশ্চাৎমুখিতার পতন হোক’’। এর দ্বারা তারা ধর্মের পতনকে উদ্দেশ্য করে। এই শ্লোগান দিয়ে ইয়াহূদীরা একটা হট্টগোল বাধিয়ে দেয়, এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সাথে তাদের দূরত্ব নির্মূল করার চেষ্টা করে এবং ধর্মীয় বিরোধগুলো মিটিয়ে দেয়ার প্রয়াশ চালায়। এভাবে ফরাসি বিপ্লব ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিবর্তে খোদ ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রূপ ধারণ করে।
  • ধর্মবিমুখ বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব:স্যাকুলারিজমের উদ্ভবের পেছনে বেশ কিছু ধর্মবিমুখ- ধর্মবিদ্বেষী মতবাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি মতবাদের উল্লেখ করা হলো:
    • বিবর্তনবাদ: ১৮৫৯ সনে ডারউইন (Charles Darwin) এর বই The Origin of Species (প্রজাতির উৎপত্তি, অনুবাদক- অধ্যাপক ম. আখতারুজ্জামান) প্রকাশিত হয়েছে। এই গ্রন্থে ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection) এবং বংশগতি তত্ত্বের উপর গুরুত্বারোপ করেন। মানুষের আসল পূর্বপুরুষ হিসেবে একটি অনুজীবকে চিহ্নিত করা হয়। যে অনুজীবটি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর একটি বদ্ধ ডোবাতে ছিল। বিবর্তনের ফলে এটি এক পর্যায়ে বানর এবং শেষ পর্যায়ে মানুষে পরিবর্তিত হয়। বিবর্তনবাদ ধর্মীয় বিশ্বাসকে উচ্ছেদ করে নাস্তিকতার বিস্তার ঘটায়। ইয়াহূদীরা সুকৌশলে এই মতবাদকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে।
    • নিতশার (Nietzsche) দর্শনের উদ্ভব: দার্শনিক নিতশা দাবী করেন- ইশ্বরের মৃত্যু হয়েছে। মানুষ হচ্ছে সুপারম্যান। মানুষকে ইশ্বরের স্থলাভিষিক্ত হওয়া উচিত।
    • দুরখীম (ইয়াহূদী) এর দর্শন: তিনি সামষ্টিক বিবেক (Group mind) তত্ত্বের ভিত্তিতে মানুষদেরকে জন্তু ও বস্তু সত্তার সম্মিলিত রূপ বলে মত প্রকাশ করেন।
    • ফ্রুয়েড (Freud) (ইয়াহূদী) এর দর্শন: তিনি বস্তুজগতের সবকিছুতে যৌন বাসনাকে মূল প্রেরণা মনে করেন এবং তাঁর দৃষ্টিতে মানুষ নিছক যৌনাকাঙ্ক্ষী প্রাণী।
    • কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) (ইয়াহূদী) এর দর্শন: তিনি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেন। মার্ক্স ‘‘অনিবার্য বিবর্তন’’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন। তিনি কমিউনিজমের প্রচারক ও প্রথম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ধর্মকে জাতিসমূহের আফিম হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
    • জঁ-পল সার্ত্র্ (Jean-Paul Sartre) তাঁর Existentialism নামক গ্রন্থে ও কলিং উইলসন (Colin Wilson) তাঁর The Outsider নামক গ্রন্থে অস্তিত্ববাদ (existentialism) ও নাস্তিক্যবাদের প্রতি আহবান জানান।
আরব ও ইসলামী বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নমুনা:
  • § মিসর: নেপোলিয়ন বোনাফোর্ট এর আক্রমনের সাথে মিসরে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুপ্রবেশ ঘটে। আল-জিবরিতি তাঁর ইতিহাসগ্রন্থে (মিসরের উপর ফরাসি হামলা ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহ শীর্ষক অংশে) এমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি তাঁর লেখায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যা স্যাকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অর্থ বহন করে। যদিও তিনি এ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করেননি। যিনি সর্বপ্রথম ‘ইলমানিয়্যাহ্‌’ বা স্যাকুলারিজম পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন তিনি হচ্ছেন- কাতারের অধিবাসী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ইলিয়াস; ১৮২৭ সালে প্রকাশিত আরবী-ফরাসি অভিধানে। খিদীভ (মিশরের শাসকদের উপাধি) ইসমাঈল ১৮৮৩ সালে ফ্রান্সের আইন মিসরে প্রবেশ করান। এই খিদীভ প্রাশ্চাত্য-সংস্কৃতির অন্ধভক্ত ছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল মিসরকে ইউরোপের একটি টুকরোতে পরিণত করবেন।
  • § ভারত: ১৭৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে ইসলামি আইন (শরিয়া) মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে। এরপর ইংরেজদের প্ররোচনায় ক্রমান্বয়ে ইসলামি আইন বিলুপ্ত করা শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সম্পূর্ণভাবে ইসলামি আইন বিলুপ্ত করা হয়।
  • § আলজেরিয়া: ১৮৩০ সালে ফ্রান্স কর্তৃক উপনিবেশ শাসনের স্বীকার হওয়ার পর ইসলামি আইন বিলুপ্ত করা হয়।
  • § তিউনিশিয়া: ১৯০৬ সালে তিউনিশিয়াতে ফ্রান্সের আইন স্থান করে নেয়।
  • § মরক্কো: ১৯১৩ সালে মরক্কোতে ফ্রান্সের আইন অনুপ্রবেশ করে।
  • § তুরস্ক: ইসলামি খেলাফত বিলুপ্ত হওয়ার পর এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক কর্তৃক সর্বক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পর তুরস্ক স্যাকুলারিজমের চাদর পরিগ্রহ করে করে। যদিও তারও আগ থেকেই কিছু কিছু লক্ষণ ও কর্মকাণ্ড দেখা দিয়েছিল।
  • § ইরাক ও সিরিয়া: উসমানী খিলাফত আমলে ইরাক ও সিরিয়া থেকে ইসলামি আইন বিলুপ্ত করা হয় এবং সেখানে ইংরেজ ও ফরাসিদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
  • § আফ্রিকার অধিকাংশ অঞ্চল: দখলদার ঊপনিবেশী শক্তির পতনের পর আফ্রিকার অনেক দেশে খ্রিস্টান রাষ্ট্রপ্রধানেরা ক্ষমতা দখল করে নেয়।
  • § ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ স্যাকুলার রাষ্ট্র।
  • § স্যাকুলার ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের প্রসার: বার্থ পার্টি, সিরিয়ান জাতীয়তাবাদী দল, ফেরাউনি মতবাদ, তুরানি মতবাদ, আরব জাতীয়তাবাদ।
  • আরব ও মুসলিম বিশ্বে উল্লেখযোগ্য স্যাকুলার ব্যক্তিবর্গ:
আহমাদ লুতফি সৈয়দ, ইসমাঈল মাযহার, কাসেম আমীন, ত্বাহা হোসাইন, আব্দুল আযিয ফাহমি, মিশেল আফলাক, আন্তুন সাদাত, সূকর্ণ, সুহার্তু, নেহেরু, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, জামাল আব্দুন নাসের, ‘‘রাজনীতিতে ধর্ম নেই; ধর্মে রাজনীতি নেই’’ এই শ্লোগানের প্রবক্তা আনোয়ার সাদাত, ড. ফুয়াদ যাকারিয়া, ড. ফারাজ ফৌদাহ প্রমুখ।
স্যাকুলারদের চিন্তাধারা ও বিশ্বাসাবলী:
  • কিছু ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্বকেও অস্বীকার করে। তাদের কেউ কেউ আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখলেও আল্লাহর অস্তিত্বের সাথে মানুষের জীবনের কোনরূপ সম্পর্ক আছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করে না।
  • নিছক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে এবং বিবেক ও অভিজ্ঞতার শাসনাধীনে মানবজীবন প্রতিষ্ঠিত হবে।
  • আধ্যাত্মিক জগৎ ও বস্তুজগতের মধ্যে দুর্ভেদ্য ব্যবধান তৈরী করা। তাদের দৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ নেতিবাচক মূল্যবোধ।
  •  ধর্মকে রাজনীতি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং নিরেট বস্তুবাদী ভিত্তির উপর জীবন প্রতিষ্ঠিত করা।
  •  জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে pragmatism (সুবিধাবাদ) প্রতিষ্ঠা করা।
  •  শাসন, রাজনীতি ও নীতি নৈতিকতার ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলীর সূত্র অনুসরণ করা।
  • অশ্লীলতা ও চারিত্রিক অবক্ষয় ছড়িয়ে দেয়া এবং পারিবারিক ভিত ভেঙ্গে দেয়া। যেহেতু পরিবার হচ্ছে সামাজিক বন্ধনের প্রথম বীজ।
  • সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও মিশনারী সংস্থাগুলোর অপচেষ্টায় আরব ও মুসলিম বিশ্বে প্রচারিত ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাসগুলো হচ্ছে-
    • ইসলাম, কুরআন ও নবুয়তের মূলে আঘাত করা।
    • এ দাবী করা যে, ইসলামের আবেদন নিঃশেষ হয়ে গেছে। ইসলাম কিছু আধ্যাত্মিক পূজা-অর্চনা ছাড়া কিছু নয়।
    • এ দাবী করা যে, ইসলামী ফিকহ বা ইসলামী আইন শাস্ত্র রোমান আইন থেকে উদ্ভুত।
    • এই দাবী তোলা যে, ইসলাম বর্তমান সভ্যতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলাম মানুষকে পশ্চাৎমুখী হওয়ার আহবান জানায়।
    • পাশ্চাত্য চিন্তাধারার আলোকে নারীমুক্তির আহবান জানানো।
    • ইসলামী সভ্যতাকে বিকৃতভাবে পেশ করা। ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক আন্দোলনগুলোকে অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করা এবং এ আন্দোলনগুলোকে সংস্কারমূলক আন্দোলন হিসেবে দাবী করা।
    • প্রাচীন সভ্যতাগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা করা।
    • পাশ্চাত্যের ধর্মহীন আইনকানুন ও কারিকুলাম আমদানী করা এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডে পাশ্চাত্যের ধারা চালু করা।

 স্যাকুলারিজম কি মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য?

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে স্যাকুলারিজম বা ধর্মহীনতা বিকাশের কোনো কারণ যদি থেকেও থাকে কোনো মুসলিম দেশে তা বিকাশের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। কেননা কোনো খ্রিস্টানকে যখন মানবরচিত সিভিল ল’ দিয়ে শাসন করা হয় তখন সে অল্প বা বিস্তর বিরক্ত হয় না। কারণ এতে করে সে এমন কোনো কিছুকে অকেজো করছে না যা মান্য করা তার ধর্ম তার উপর আবশ্যক করে দিয়েছে; কেননা তাঁর ধর্মে জীবনবিধান হিসেবে কিছু নেই। কিন্তু মুসলিমের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। মুসলিমের ঈমানই তাঁকে আল্লাহর আইনের শাসন গ্রহণে বাধ্য করে।
তাছাড়া – যেমন ড. ইউসুফ আল-কারাদাভী বলেন- ধর্ম থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখা হলেও খ্রিস্টান ধর্ম তার প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাতে অটুট থাকবে এবং খ্রিস্টান ধর্মরক্ষী পোপ, ফাদার, মাদার ও ধর্মপ্রচারকগণ বিনা প্রতিবন্ধকতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে। পক্ষান্তরে মুসলিম দেশে যদি এ মতবাদ চালু করা হয় তাহলে ইসলাম শক্তিহীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। কারণ ইসলাম কোনো ব্যক্তির জন্য পোপ, যাজক, এক্লিউরিস এর মত আধিপত্য অনুমোদন করে না। ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রাঃ) ঠিকই বলেছেন- ‘‘আল্লাহ তাআলা শাসককে দিয়ে যা বাস্তবায়ণ করান, কুরআন দিয়ে তা বাস্তবায়ণ করান না।’’
  • স্যাকুলার মতবাদের আদর্শিক ও বিশ্বাসগত শেকড়ঃ
প্রথমতঃ গির্জার সাথে শত্রুতা। দ্বিতীয়ত ধর্মের সাথে শত্রুতা, চাই সে ধর্ম বিজ্ঞানের পক্ষে অবস্থান নিক অথবা বিজ্ঞানের বিপক্ষে অবস্থান নিক।  স্যাকুলারিজম প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ইয়াহূদীদের বড় ভূমিকা রয়েছে; যাতে করে তারা এর মাধ্যমে তাদের ও বিশ্বের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যকার ধর্মীয় দেয়াল নির্মূল করতে পারে।
আলফ্রেড ওয়াইট হু বলেন: ‘‘যে ইস্যুতেই ধর্ম বিজ্ঞানের বিরোধিতা করেছে সেখানে বিজ্ঞানের অভিমতই সঠিক পাওয়া গেছে এবং ভুল সবর্দা ধর্মের মিত্র।’’ যদি এ উক্তিটি ইউরোপে প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে সঠিক হয়েও থাকে, ইসলামের ব্যাপারে এ বক্তব্য সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যাত এবং কোনো বিবেচনায় সঠিক নয়। কারণ ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণিত তত্ত্বগুলোর মাঝে কোনো সংঘর্ষ নেই। ইসলাম ও বাস্তব বিজ্ঞানের মাঝে কখনো কোনো বিরোধ বাঁধেনি, খ্রিস্টান ধর্মের সাথে যেরূপ বিরোধ বেঁধেছিল। একজন সাহাবী থেকে একটি উক্তি বর্ণিত আছে- ‘‘ইসলাম যা আদেশ দিয়েছে সে বিষয়ে বিবেক কখনো বলেনি যে, হায়! এ ব্যাপারে যদি নিষেধ করা হত। অথবা ইসলাম যা থেকে বারণ করেছে সে বিষয়ে বিবেক কখনো বলেনি যে, হায়! ইসলাম যদি এ ব্যাপারে আদেশ দিত।’’ বৈজ্ঞানিক বাস্তব তত্ত্ব-উপাত্তগুলো এ উক্তিকে সত্য প্রমাণিত করে। পাশ্চাত্যের একদল বিজ্ঞানীও এ কথার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁদের মুখনিসৃত শত শত উক্তির মাধ্যমে ইসলামের এই বৈশিষ্টের প্রতি তাঁদের অনুরক্ততা ও এ বৈশিষ্টের সত্যতা প্রকাশ পেয়েছে।
‘‘বিজ্ঞান ও ধর্মের মাঝে শত্রুতা’’ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপকতা প্রদান, যাতে এর আওতায় ইসলামও এসে যায়। অথচ ইসলাম গির্জার ন্যায় জীবন ও বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। বরং অভিজ্ঞতাবাদ পদ্ধতি (empirical method) প্রয়োগে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে ইসলামই ছিল অগ্রণী।  আখেরাতকে অস্বীকার করা এবং আখেরাতের জন্য আমল না করা এবং এ বিশ্বাস রাখা যে, ভোগ ও উপভোগের জন্য দুনিয়ার জীবনই একক ক্ষেত্র।
  • ইসলাম কেন স্যাকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) প্রত্যাখান করে?
    • স্যাকুলারিজম (ধর্মহীনতা) যা আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা নামে প্রসিদ্ধ তা মানব প্রকৃতির একটি বিশেষ দিককে উপেক্ষা করে। দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের দেহের চাহিদা পূরণের উপর গুরুত্বারোপ করে। কিন্তু আত্মার চাহিদার প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না।
    •  পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ মতবাদটির উৎপত্তি হয়েছে। আমরা প্রাচ্যবাসীদের নিকট এটি একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত অজানা অচেনা চিন্তাধারা বৈ কিছু নয়।
    •  ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে। যার ফলে ব্যক্তিতন্ত্র, জাতেভেদ তথা উঁচুনীচু বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, মতবাদভিত্তিক বিভেদ, গোত্রীয় বিভেদ, জাতীয়তাভিত্তিক বিভেদ, দলাদলি, শ্রেণী বৈষম্য ইত্যাদির উন্মেষ ঘটে।
    •  এই মতবাদ নাস্তিকতা, পাশবিকতা, বিচ্ছিন্নতা, দুর্নীতি, প্রজন্মের বিনাশ ইত্যাদির প্রসার ঘটায়।
    •  ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদেরকে পাশ্চাত্যের বিবেক দিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য করে। যার ফলে আমরা নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশাকে নিন্দা করব না। আমরা মুসলিম সমাজের স্বভাব-চরিতকে ভুলুণ্ঠিত করব এবং অনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সমাজের রুদ্ধদারকে খুলে দেব। ধর্মনিরপেক্ষতা সুদী কারবারের বৈধতা দেয় এবং সিনেমা, নাটক, চলচ্ছিত্র ইত্যাদি শিল্প হিসেবে অতি মর্যাদা দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ছায়াতলে প্রত্যেক মানুষ অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াস চালায়।
    •  ধর্মনিরপেক্ষতা পাশ্চাত্য সমাজের সমস্যাগুলো আমাদের সমাজে টেনে আনে। যেমন পরকালের হিসাবনিকাশকে অস্বীকার করা। যার ফলশ্রুতিতে মানুষ ধর্মীয় ভাবধারার বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত হয়ে জাগতিক রিপু যেমন- লোভলালসা, ব্যক্তিস্বার্থ, অস্তিত্বের লড়াই ইত্যাদি দ্বারা তাড়িত হয়ে জীবন যাপন করে; সেখানে আত্মার বিবেচনা একেবারে শূণ্য।
    •  ধর্মনিরপেক্ষতা বিকাশ ঘটলে জাগতিক জ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়; যে জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ নির্ভর। গায়েবী বিষয়াবলীকে উপেক্ষা করা হয়। যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, পূণরুত্থান, পূণ্য ও পাপ। এর ফলে এমন এক সমাজের উদ্ভব ঘটে যে সমাজের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে- দুনিয়ার ভোগ ও সস্তা সব খেলতামাশা।
  • ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসার ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কেন্দ্রবিন্দুধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি ইউরোপে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনৈতিক অস্তিত্ব অর্জন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গোটা ইউরোপ জুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্তার লাভ করে। বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও মিশনারীর প্রভাবে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে রাজনীতি ও শাসনকার্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার
পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা পরিস্কার যে – রাষ্ট্রীয় জীবন ও সামাজিক জীবন থেকে ধর্মকে বহিষ্কার করে জাগতিক জ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধির ভিত্তিতে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার আহবানই- ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মতে, ধর্ম মানুষের মনের খাঁচায় বন্দি থাকবে, খুবই সীমাবদ্ধ পরিসরে ধর্মকে প্রকাশ করা যাবে। অথচ যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তকে আইন হিসেবে গ্রহণ করে না এবং আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোকে সে নিষিদ্ধ করে না- সে মুরতাদ, সে মুসলিম নয়। দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে তার যুক্তি খণ্ডন করা ও তাকে তওবা করার আহ্বান জানানো ওয়াজিব- যেন সে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ পায়। অন্যথায় ইহকালে ও পরকালে তার ব্যাপারে ইসলাম ত্যাগকারী মুরতাদের বিধান প্রযোজ্য হবে।
নিম্নোক্ত রেফারেন্সগুলো হতে আরো বিস্তারিত জানুন:
  • জাহিলিয়াতুল কারনিল ইশরিন (বিংশ শতাব্দীর জাহেলিয়াত), লেখক: মুহাম্মদ কুতুব।
  • আলমুস্তাকবাল লি হাযাদ্বীন (এই দ্বীনের ভবিষৎ), লেখক: সাইয়েদ কুতুব।
  •  তাহাফুতুল ইলমানিয়্যাহ (ধর্মনিরপেক্ষতার অসারতা), লেখক: এমাদুদ্দীন খলিল।
  • আল ইসলাম ওয়াল হাদারাতুল গারবিয়্যাহ (ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতা), লেখক: মুহাম্মদ মুহাম্মদ হোসাইন
  •  আল-ইলমানিয়্যাহ (ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ), লেখক: সাফার ইবনে আব্দুর রহমান আলহাওয়ালী
  • তারিখুল জামইয়্যত আসসিরিয়্যাহ ওয়াল হারাকাত আলহাদ্দামাহ (গোপন সংগঠন ও ধ্বংসাত্মক আন্দোলনগুলোর ইতিহাস), লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আনান।
  • আলইসলাম ও মুশকিলাতুল হাদারাহ (ইসলাম ও সভ্যতার দ্বন্ধ), লেখক: সাইয়েদ কুতুব।
  • আলগা-রাহ আলাল আলাম আল ইসলামী (মুসলিম বিশ্বের উপর হামলা), অনুবাদ: মুহিববুদ্দীন আলখতীব ও মুসাঈদ আলইয়াফী।
  •  আল-ফিকর আল-ইসলামী ফি মুওয়াজাতিল আফকার আলগারবিয়্যাহ (ইসলামী চিন্তাধারা বনাম পাশ্চাত্য চিন্তাধারা), লেখক: মুহাম্মদ আল-মুবারক।
  •  আল-ফিকর আল-ইসলামী আলহাদীস ওয়া সিলাতুহু বিল ইসতিমার আলগারবি (আধুনিক ইসলামী চিন্তাধারা ও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের সাথে এর সম্পর্ক), লেখক: মুহাম্মদ আল-বাহী।
  •  আলইসলাম ওয়াল ইলমানিয়া ওয়াজহান বি ওয়াজহ (ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা পরস্পর মুখোমুখি), লেখক: ড. ইউসুফ কারাদাবী।
  •  আলইলমানিয়া: আন্নাশআ ওয়াল আছার ফিশ শারকি ওয়াল গারব (ধর্মনিরপেক্ষতা: উৎপত্তি, প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে এর প্রভাব), লেখক: যাকারিয়া ফায়েদ।
  •  ওজুবু তাহকিমুস শরিয়া ইসলামিয়া লিল খুরুজে মিন দায়িরাতিল কুফর আলই‘তিকাদি (কুফরী বিশ্বাসের গন্ডি থেকে বেরোবার জন্য ইসলামি শরিয়া মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালনার আবশ্যকতা), লেখক: ড. মুহাম্মদ শাত্তা আবু সাদ, কায়রো, ১৪১৩হিঃ
  •  জুযুরুল ইলমানিয়্যাহ (ধর্মনিরপেক্ষতার গোড়ার কথা), লেখক: ড. আসসাইয়েদ আহমাদ ফারাজ, দারুল ওফা, আলমানসুরা, ১৯৯০ খ্রিঃ
  •   ইলমানি ওয়াল ইলমানিয়া (ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষতা), লেখক: ড. আসসাইয়েদ আহমাদ ফারাজ, ১৯৮৬ খ্রিঃ
সমাপ্ত

মুসলিম উম্মাহর মানসিক বিপর্যয়ঃ কারণ ও প্রতিকার-৩



গ্যালারি

মূল ঃ ড. আব্দুল্লাহ আল-খাতির
অনুবাদ ঃ মুফতী কিফায়াতুল্লাহ
সম্পাদনা ঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুররহমান

মানসিক বিপর্যয় হতে মুক্তি লাভের উপায়

{ইতিপূর্বে মানসিক বিপর্যয়ের কতিপয় লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যায়ে উক্ত ব্যাধি হতে আরোগ্য লাভের উপায় সম্পর্কে পথ-নির্দেশ দেয়া হলো, যা অনুসরণ করলে মুসলিম উম্মাহ এ ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয় হতে মুক্তি লাভ করে ভবিষ্যত বিনির্মাণে অগ্রসর হতে পারবে বলে আশা করা যায়}
  • এক. সমস্যা উপলব্ধি করা । প্রথমতঃ আমাদেরকে সমস্যা উপলব্ধি করতে হবে। কারণ, সমস্যা উপলব্ধি না করলে সমাধানের প্রশ্নই উঠে না। এজন্য বলা হয় ‘সমস্যা উপলব্ধি সমাধানের অর্ধাংশ’। সমস্যা উপলব্ধির সাথে সাথে সমস্যা সৃষ্টির কারণ চিহ্ণিত করতে হবে। অন্যথায় সঠিক পথ নির্ণয় করা সম্ভব হবে না। অতএব, প্রথমেই আমাদেরকে বুঝতে হবে, আমরা ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়ের শিকার এবং এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন হতে সরে পড়া।
  • দুই. সহীহ ঈমানের তারবিয়্যাত ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা । আমাদেরকে সহীহ ঈমানের তারবিয়্যাত ও প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কারণ বিপর্যয় উত্তরণের এ দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার প্রথম পদক্ষেপই হলো বিশুদ্ধ ঈমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ। কাজেই আবাল-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ তথা সর্বস্তরের মুসলিমদের খালেস দ্বীনের পূর্ণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ঈমানের এমন স্তরে পৌঁছতে হবে, যে স্তরে পৌছে তারা আল্লাহ ছাড়া অপর কোন শক্তিকে ভয় করবে না।<ঈমান কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা বা দৃষ্টিভঙ্গির নাম নয়, যা কেবল চিন্তার জগতে সীমাবদ্ধ থাকে। এজন্য বিশুদ্ধ ঈমান আক্বীদাকে প্রকৃত অর্থে অন্তরে স্থাপন করতে হবে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তার বাস্তবায়ন ও প্রতিফলন ঘটাতে হবে।বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এক শ্রেণীর লোকের কাছে ঈমান শুদ্ধকরণ ও তা কর্মজীবনে বাস্তবায়নের কোন গুরুত্ব নেই। অধিকন্তু তারা এ বিষয়ের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করে থাকে, তোমরা কেবল আমল-আক্বীদা শুদ্ধ করার কথাই বলো ঃ কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমসহ অপরাপর ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে কিছুই বল না!এর জবাবে আমরা বলবো, সাম্রাজ্যবাদ, পুজবাদ, কমিউনিজমসহ সকল ইসলাম-বিরোধী অপশক্তি ও ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে সহীহ আক্বীদা বিশ্বাসই পারে কথা বলার শক্তি ও সাহস যোগাতে : চিন্তা ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে এবং সর্ব ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র ফুটিয়ে তুলতে।ঈমান আক্বীদা বিশুদ্ধ না হলে বাতিলের ভয়ে অন্তর ভীত থাকে। তার বিরুদ্ধে কথা বলার সৎ সহস সৃষ্টি হয় না। নানা প্রকার জেহালাত ও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে ক্ষুদ্র মাখলুকের ভয়ে হীনমন্য ও বিপর্যন্ত জীবন যাপন করতে হয়। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে আমি কতিপয় উপমা পেশ করছি।
    যামানায়ে জাহেলিয়্যার মূর্খ লোকেরা যখন কোন উপত্যকায় গমন করতো তখন দুষ্ট জিন ও প্রেতাত্মাদের ভয়ে এতই ভীত হতো যে, তারা সামনে এগিয়ে চলার মনোবল পর্যন্ত হারিয়ে ফেলত। জিনদের প্রতি তাদের মাত্রাতিরিক্ত ভয় ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে তাদের কাছে সাহায্য চাইতো। তারা বলতো “হে উপত্যকাপতি, আমরা এখানকার প্রেতাত্মা হতে তোমার আশ্রয় চাই, তুমি আমাদের আশ্রয় দাও।”
    তাদের এরূপ করার কারণ ছিল, জিনদের সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস। জ্বিনদেরকে তারা ত্রাণকর্তা মনে করত।
    কিন্তু আমরা যেহেতু জিনদের ভয়ে ভীত নই এবং জিনদের সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা রয়েছে, সেহেতু আমরা জিনদেরকে ত্রাণকর্তা মনে করে তাদের সাহায্য কামনা করি না, বরং সর্বাবস্থায় আমরা আল্লাহরই সাহায্য ও নিরাপত্তা কামনা করি। কারণ, জিন সম্পর্কে আমাদের বোধ ও বিশ্বাস কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আমরা সম্যক অবগত। আমরা জানি, জিনদের মধ্যে সৎ ও অসৎ দু’ধরণের জিন রয়েছে। পবিত্র কুরআনে জিনদের স্বীকারোক্তি এভাবে বর্ণিত হয়েছে ঃ
    وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا . وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ
    “আমাদের কেউ কেউ সৎকর্মপরায়ণ এবং কেউ আবার এরূপ নয়। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথে বিভক্ত। আমাদের কিছু সংখ্যক মুসলিম এবং কিছু সংখ্যক অন্যায়কারী। (সুরা জিনঃ১১, ১৪)
    জিন সম্প্রদায়ের কিছু সংখ্যক এমনও রয়েছে, যারা দ্বীনের দা’য়ী হিসাবে আল্লাহর পথের দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। জিন সম্পর্কে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হল, এরা আল্লাহর এক প্রকার সৃষ্ট জীব, যারা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। যেমন অন্যান্য সৃষ্টি আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন প্রকার ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। এ লালিত বিশ্বাস আমাদেরকে এমন শক্তি, সাহস ও এক্বীন প্রদান করে যে, আমরা যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার সৎসাহস পাই এবং যে কোন পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হই। বস্তুতঃ সঠিক আক্বীদা সামগ্রিক জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব উপহার দেয়।
    সঠিক ধর্ম-বিশ্বাসই যে মানসিক শক্তির উৎস এবং সর্ব প্রকার প্রকার মনস্তাত্বিক দুর্বলতা বিদূরণের প্রধান উপকরণ সে বিষয়ে আরেকটি উপমা দেয়া যাক।
    কোন বিষয়ে শুভাশুভ ধারণা পোষণ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফে বর্ণিত একখানা হাদীসে রাসূলে পা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ
    لا طيرة وأحب الفال الصالح
    “কোন বিষয়ে অশুভ ধারণা রাখা ঠিক নয়, আমি শুভ ধারণা পোষণ করাকেই পছন্দ করি।” (বুখারী ২/৮৫৬)
    অন্যত্র ইরশাদ করেন ঃ لا عدوى ولا طيرة
    “ইসলামে শুভাশুভের ধারণার ভিত্তি নেই।” (বুখারী ২/৮৫৬)
    এই শুভাশুভের ধারণা জাহেলী যুগের মানুষের অন্তরে এতই প্রবলভাবে বদ্ধমূল ছিল যে, সফরের উদ্দেশ্যে বহির্গমনকালে যদি তারা কোন কাল পাখি দেখতো তাহলে তারা সফরের ইচ্ছা ত্যাগ করতো। কারণ, কালো পাখিকে তারা অশুভ লক্ষণ মনে করতো। এদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অমূলক ভয় যে এক প্রকার মনস্তাত্বিক বিপর্যয়- এতে কোন সন্দেহ নেই।
    পক্ষান্তরে মুসলিমগণ যখন সঠিক আক্বীদা শিক্ষা লাভ করবে তখন বস্তুর শুভাশুভের ধারণাকে ভিত্তিহীন বলে জ্ঞান করবে। তারা আরও বুঝবে যে, এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে জাহেলী যুগের মানুষদের কতই না বিপর্যস্ত জীবন যাপন করতে হয়েছে, তখন মুসলিমরা শুভাশুভের এই অমূলক ধারণাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। বস্তুতঃ এতদবিষয়ে যখন মুসলিমদের বোধ ও বিশ্বাস বিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন তারা বাস্তবিকভাবেই প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী হবে এবং তাদের জীবনে এক ক্রিয়াশীল নব অধ্যায়ের সূচনা হবে।
    কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে, এক শ্রেণীর মুসলিম এখনো সেই জাহেলী যুগের মনোভাব ও ভিত্তিহীন আক্বীদা নিয়ে বসবাস করছে। তারা ঘরের ফটকে গরু বা ঘোড়ার হাড় এবং গাড়ীতে শিশুদের জুতা ঝুলিয়ে রাখে। তাদের ধারণা হলো, এগুলো কুদৃষ্টি হতে গাড়ী ও বাড়ীকে রক্ষা করবে। এটা একটা অলীক ধারণা। এ ধারণা পোষণের কারণ হলো কুদৃষ্টি ও জিনদের প্রতি তাদের সীমাহীন ভয়-ভীতি, যার ফলে তারা অত্যন্ত বিপর্যস্ত জীবন যাপন করে।
    পক্ষান্তরে যে মুসলিম প্রকৃত অর্থেই সঠিক আক্বীদা পোষণ করে, সে সর্বদা স্থিতিশীল জীবন যাপন করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জীবনের সর্বস্তরে ইসলামী আদর্শ মেনে চলে। কোন পর্যায়েই সে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় না। উদাহরণতঃ জীবিকা নির্বাহ বা রিযিক যোগাড়ের বিষয়টি মানব জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে বহু মুসলিম এমন রয়েছেন, যারা ইসলামী বিধি-বিধান, শরয়ী অুনশাসন অহরহ লংঘন করে চলছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখে যে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা প্রতিটি জীবের জীবিকা ব্যবস্থা করেন, তিনি সকলের রিযিকদাতা-রায্যাক, তারা কখনও রিযিক জোগাড় করতে গিয়ে হারাম কাজে লিপ্ত হয় না। তাদের পক্ষে তা কখনো সম্ভবপরও নয়।
    এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর ঘটনা আমার মনে পড়েছে। লন্ডনে এক আলজেরীয় মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হলে সে তার এই ব্যক্তিগত ঘটনাটি আমাকে শোনায়। যুবকটি বলল ঃ
    “একদিন আমি কাজের সন্ধানে এক হোটেলে গেলাম। হোটেল মালিক যথারীতি আমার প্রাইভেট ইন্টারভিউ গ্রহণ করল। কিন্তু তার কোন ফলাফল আমাকে জানালো না, বরং বলল ঃ এ বিষয়ে আমাদের একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে, সেখানেই ফলাফল জানানো হবে। তোমার বিষয়টিও আমরা ভেবে দেখবো।
    “অতঃপর সে আমাকে মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানালো। হোটেল মালিকের এমন আমন্ত্রণে আমি বিপাকে পড়ে গেলাম। মুসলিম হিসাবে তার এ আহ্বানের সাড়া দেয়া আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। কিন্তু এ মূহুর্তে সাড়া না দিলে যে রিযিকের সম্ভাব্য পথটিও বন্ধ হবার উপক্রম! এজন্য আমি সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলাম। পরক্ষণেই এ স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, মালিক আমাকে চাকুরীর জন্য গ্রহণ করুক বা না-ই করুক, আমি তার এ আমন্ত্রণে কিছুতেই সাড়া দেব না এবং মদও পান করব না। তাই বললাম ঃ “জনাব! আমি মুসলিম, আমাদের ধর্মে মদ্যপান হারাম। এজন্য আপনার আমন্ত্রণে সাড়া দিতে পারলাম না।”
    এ কথা শুনে হোটেল মালিক বিস্মিত হয়ে বললো, তাই নাকি!
    আমি বললাম ঃ হ্যাঁ তা-ই!
    মালিক বলল ঃ তাহলে আর বিলম্ব নয় তুমি এখন থেকেই চাকুরীর জন্য নির্বাচিত।
    আমি বিস্মিত হয়ে বললাম ঃ তা কীভাবে?
    “মালিক বলল ঃ এখানে হোটেল কর্মচারীদের নিয়ে ভীষণ সমস্যা। এরা রাতভর মদের নেশায় মত্ত হয়ে আমোদ ফুর্তিতে কাটায়। তারপর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। এজন্য প্রত্যহ আসতে তাদের দেরী হয়। দেরী করা ছাড়া তারা আসতেই পারে না। তুমি যেহেতু মদ পান করো না সেহেতু তোমার ঘুমাতেও দেরী হবে না, আর আসতেও বিলম্ব হবে না। কাজেই তোমার জন্য সু-সংবাদ, এ হোটেলের চাকুরী প্রার্থীদের মধ্যে তোমাকেই প্রথমে নির্বাচন করা হল।”
    বস্তুতঃ মানুষ যখন এ এক্বীন করবে যে, রিযিক একমাত্র আল্লাহরই হাতে, কেউ তার রিযিক বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে না, তখন আল্লাহ তাআলা তার জন্য রিযিকের অসংখ্য দ্বার উন্মোচন করে দেন।
    উপরোল্লিখিত ঘটনাই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেখানে এ যুবক ধারণাই করতে পারেনি যে, নিজেকে মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেয়ার পর এবং মদ্যপানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার পরও তাকে চাকুরীর জন্য গ্রহণ করা হবে, সেখানে তাকে কতইনা সম্মানের সাথে চাকুরীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
  • তিন. পার্থিব ঘনিষ্ঠতা বর্জন করা
    যে সব বিষয় নিছক দুনিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট, আখেরাতের কোন ফায়েদা তাতে নেই, কিংবা আখেরাতের জন্য তা ক্ষতিকর, সেসব বিষয় থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। সাথে সাথে আখেরাতের সাথে সম্পর্ক গভীর করতে হবে। অর্থাৎ পার্থিব লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে নেক আমলের প্রতি মনোনিবেশ করতে হবে।এক শ্রেণীর লোভাতুর মানুষ রয়েছে, যারা এসব বিষয়ের কোন বিবেচনা না করেই বিভিন্ন ভোজানুষ্ঠান, অলীমা, বৌভাবত যিয়াফত, চেহলাম, কুরআনখানির দাওয়াতের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। এদের সার্বক্ষণিক চিন্তা-ফিকিরই কেবল এসব অনুষ্ঠান। এদের ব্যক্তিগত ইমেজ ও আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছুই নেই। এর ফলে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রভাব ক্রমশঃ লোপ পেতে থাকে। ফলে এরা সামজে মর্যাদাহীনভাবে জীবন যাপন করে।পক্ষান্তরে এমন বহু আলেম রয়েছেন যারা দাওয়াত যিয়াফতের লোভে ঘুরে বেড়ানো তো দূরের কথা, তাঁরা হাদিয়া গ্রহণ করতেও চিন্তা করেন। বিশেষ করে আত্মম্ভরী ও অহংকারী প্রকৃতির লোকদের হাদিয়া। কারণ, দুনিয়ার প্রতি তাঁদের কোন আকর্ষণ নেই, নেই কোন লোভ-লালসা। এজন্য তাঁরা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে মহান ও উঁচু মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকেন। মানুষের উপর তাঁদের ব্যক্তিত্বের প্রখর প্রভাব সর্বদা বিরাজমান থাকে। আমরাও যদি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণে পার্থিব লোভ-লাসা পরিত্যাগ করি, তাহলে মানব সমাজে আমরাও মাথা উঁচু করে সগৌরবে বসবাস করতে পারবো এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হতে পারবো। ইতিহাসে এর বহু নজীর বিদ্যমান। আগের দিনকার রাজা-বাদশাগণও নির্লোভ জ্ঞানী-গুণী দুনিয়া বিমুখ আলেমদের খুবই কদর করতেন।একবার জনৈক বাদশা এক দরবারবিমুখ আলেমকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার শাহী দরবারে আসেন না কেন?আলেম সাহেব বললেন ঃ আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব, তবে তার আগে আমার জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। বাদশা দাম্ভিক ও জালেম প্রকৃতির ছিল বিধায় উক্ত আলেমকে এমন আবেদন করতে হলো। বাদশা বললেন ঃ ঠিক আছে, আপনার জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হলো, আপনি নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন।
    এবার আলেম দৃঢ় মনোবল নিয়ে বললেন ঃ আমি যদি স্বেচ্ছায় দরবারে না আসি, তাহলে আমাকে ডেকে পাঠাবেন না। আর আমি যদি নিজে আপনার কাছে কিছু না চাই, তাহলে আমার জন্য কিছু পাঠাবেন না। অর্থাৎ আলেম সাহেব কারণ না দর্শিয়ে তাকে না ডাকার আহ্বান জানালেন।
    আলেম সাহেবের এমন জবাবে বাদশা ক্ষুদ্ধ হলেন বটে, কিন্তু পূর্ব অঙ্গীকারের কারণে ক্ষোভ সংবরণ করে গেলেন। বুঝে নিলেন, এ আলেমকে কখনো অনুগত করা যাবে না। বস্তুতঃ দুনিয়া বিমুখীতাই আমাদের মর্যাদাশীল জীবন, স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ও আকশছোঁয়া মনোবল প্রদান করতে পারে।
  • চার. ইসলাম ও মুসলিমদের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস অধ্যায়ন করাআমাদেরকে ইসলাম ও মুসলিমদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অধ্যায়ন করতে হবে। এ অধ্যায়ন নিছক আত্ম-প্রশান্তি লাভের জন্য নয়, বরং ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তেই তারীখ ও সীরাতের গ্রন্থাদি অধ্যায়ন করতে হবে।এ বিষয়ে আল্লামা ইবনে কাসীরের (রহ.) “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” একটি অদ্বিতীয় ইতিহাস গ্রন্থ। এটি অধ্যায়ন করলে বিস্ময়কর ঐতিহাসিক কাহিনী, সীরাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তৎপরবর্তী মুসলিমদের উত্থান ও পতনের নির্ভূল বর্ণনা জানা যাবে।এটি অধ্যায়নে আপনার মানসপটে প্রকৃত মুসলিমের নির্মল প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠবে এবং আপনার মনে আশার আলো জ্বলে উঠবে।বর্তমান যুগের মুসলিমদের আচার-আচরণ দিয়ে প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ, আমাদের চরিত্র, আমাদের আমল-আখলাক মারাত্মকভাবে ত্র“টিপূর্ণ। এ জন্য আমাদের আমল দিয়ে আসল মুসলিমের অনুসন্ধান না করাই ভাল। কারণ, এতে আপনি নিরাশ হবেন এবং ভাববেন, উম্মতের দায়ী, ইমাম ও আলেমদের যদি এ দুরবস্থা হয়, তাহলে মানুষের সমাজে বাস না করে বন-জঙ্গলে নির্জনবাসই শ্রেয়। অথচ এ ধরণের চিন্তা-ভাবনা মোটেও ঠিক নয় এবং তা অবশ্যই বর্জনীয়। বরং কর্তব্য হলো, ইতিহাস ভালভাবে অধ্যায়ন করে মুসলিমদের শক্তির উৎস খুঁজে বের করা এবং তাদের সার্বিক সংশোধণ, পরিপূর্ণ আমলী যিন্দেগী গঠন ও স্বর্ণোজ্জ্বল অতীতের দিকে প্রতাবর্তনের পথ ও পদ্ধতি অনুসন্ধান করা। এতে মুসলিমরা হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।
  • পাঁচ. যুব সমাজকে উন্নত চরিত্র ও উঁচু মনোবলের দীক্ষা দান করাজাতির মেরুদন্ড যুব সমাজকে উন্নত চরিত্র, উচ্চাকাঙ্খা ও বীরত্বের দীক্ষা দিতে হবে। গাফলতীর ঘুম ভেঙ্গে যুবকদেরকে ইসলামী পুনর্জাগরণের সব চেতনায় উজ্জীবিত করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে উচুঁ মনোবল ও বীরত্বের শিক্ষা দিতেন। সে সঙ্গে যে সকল কাজের দ্বারা হীনমন্যতা দূরিভূত হয়ে মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়, সে সব কাজে তিনি উৎসাহ প্রদান করতেন। যেমন, তিনি জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য শ্রম-সাধনা ও পরিশ্রম করে রিযিক যোগাড়ের শিক্ষা দিতেন।কাজেই প্রত্যেকের কর্তব্য হল, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সম্ভাব্য সকল বৈষয়িক উপকরণ গ্রহণ করা। এতে শত্র“পক্ষ আমাদের উপর প্রভাব খাটানোর সুযোগ পাবে না। উপরন্তু মুসলিমরা যে কোন বাতিল অপশক্তির মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।এখানে (লন্ডন) বহু মুসলিম রয়েছে, যারা জীবনের অধিকাংশ সময় রাষ্ট্রীয় ভাতার উপর নির্ভর করে চলে। এদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার কোন ফিকির নেই, যার কারণে এরা সরকারের কোন ইসলাম বিরোধী পদক্ষেপের প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। সর্ব ক্ষেত্রেই এদেরকে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। কারণ, প্রতিবাদ করলে যে রাষ্ট্রীয় ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তাদের জীবন বাঁচানোই মুশকিল হয়ে পড়বে।কিন্তু এখানকার মুসলিমগণ ইচ্ছা করলে অর্থোপার্জনের বহু ক্ষেত্র যেমন মিল, ফ্যাক্টরী ইত্যাতি প্রতিষ্ঠা করতে পারতো। এতে তারা পরমুখাপেক্ষিতার গ্লানিমুক্ত হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতো এবং এমন শক্তি সহস ক্ষমতার অধিকারী হতো যে, তারা সর্ব ক্ষেত্রেই কুফরী শক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে সক্ষম হতো।
    এ কথা চিরসত্য যে কর্ম-বিমুখিতাই হল পরমুখাপেক্ষিতার প্রধান কারণ। আর মুখাপেক্ষিতা হীনমন্যতার শীর্ষ উপকরণ। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্মে অবহেলা ও অলসতাকে সর্বদা অপছন্দ করতেন। তাই উম্মতকে এসব মন্দ স্বভাব থেকে মুক্তি লাভের জন্য নিম্নোক্ত দুআ দ্বারা আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে বলেছেন ঃ
    اللهم إنى أعوذبك من الهم والحزن وأعوذبك من العجز والكسل وأعوذبك من غلبة الدين وقهر الرجال.
    অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি দুঃশ্চিন্তা ও পেরেশানী হতে আপনার আশ্রয় চাই। আরও আশ্রয় চাই অক্ষমতা, অলসতা, ঋণবৃদ্ধি ও মানুষের অযাচিত প্রভাব থেকে। (বুখারী ঃ ২/৯৪১)
    মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুআ এ জন্য শিক্ষা দিয়েছেন যে, পেরেশানী মানুষের সৎ চিন্তাকে নষ্ট করে দেয়। অকর্মণ্যতা, অলসতা ও ঋণবৃদ্ধি মানুষকে অপরের গোলামে পরিণত করে। এজন্য এগুলো হতে বেঁচে থাকার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় এবং সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করা কর্তব্য।
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী মুসলিমের প্রসংশা করে ইরশাদ করেছেন ঃ
    المؤمن القوي خير وأحب إلى الله من المؤمن الضعيف وفى كل خير
    “সবল মু‘মিন দুর্বল মু’মিন অপেক্ষা উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যে কল্যাণ নিহিত।”
    তিনি আরো ইরশাদ করেন ঃ
    أحرص على ما ينفعك واستعن بالله ولا تعجز وان أصابك شئ فلا تقل لو أنى فعلت كذا لكان كذا وكذا ولكن قل قدر الله وما شاء الله فعل.
    “তোমরা কল্যাণকর বিষয়ের কামনা করবে। কোন কাজে অক্ষমতা প্রকাশ না করে আল্লাহর সাহায নিয়ে তা অব্যাহত রাখবে। কখনো কোন মুসিবতে নিপতিত হলে হতাশ হয়ে এমন বলবে না যে, হায়! যদি এমন না করে অমন করতাম, তাহলে এ মুসিবতে পড়তে হতো না। বরং বলবে ঃ
    قدر الله ما شاء الله فعل
    “এটা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন।” (মুসলিম ঃ ২/৩৩৮)
    সুতরাং কখনো বিপদগ্রস্ত হলে হাতাশ না হয়ে দৃঢ় সাহসের সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সচেষ্ট হবে। কেননা হতাশ হয়ে নিজের কাজে নিজেকে তিরস্কৃত করতে থাকলে পরিণাম আরও মন্দ হবে।
    এজন্য প্রত্যেক মুসলিমের সৎ সাহস ও দৃঢ় মনোবল থাকা চাই। কখনো ভুলক্রমে কোন অঘটন ঘটে গেলে কিংবা কোন সমস্যা দেখা দিলে যেন এই মনোভাব নিয়ে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে যে, এটাতো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য অবধারিত, তিনি যা ইচ্ছা তা’ই করতে পারেন। এ অঘটন ও সমসা সৃষ্টির ব্যাপারে আমার কোন হাত নেই, অতএব, হতাশ হওয়ারও কোন কারণ নেই। মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন ঃ
    لوم النفس يورث الاكتئاب
    অর্থাৎ আত্ম ভর্ৎসনা নৈরাশ্য টেনে আনে।
    এজন্য হাতাশ না হয়ে নব উদ্যমে কাজ করে যাওয়া এবং ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে কাজে আত্মনিয়োগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কেউ যদি সূচনাতেই নিজেকে তিরস্কার করে, তাহলে পরিণতিতে সে ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় নিপতিত হবে। কারণ, কোন ব্যক্তিকে ভর্ৎসনা করলে যেমন সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, তদ্রুপ নিজের মনকে তিরস্কৃত করলে সেও দুশ্চিন্তায় নিপতিত হয়। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আত্মভর্ৎসনা করতে নিষেধ করেছেন এবং বিপদ বা কোন সমস্যা দেখা দিলেন-
    قدر الله وما شاء الله فعل
    “এটা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করেন।” কিংবা
    حسبنا الله ونعم الوكيل
    “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং মঙ্গলময় কর্মবিধায়ক”
    বলে নব উৎসাহে কাজ শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাক্য দু’টি বলতে নির্দেশ দিয়ে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, বিপদে ভেঙ্গে পড়ার কোন কারণ নেই। নব উদ্দীপনায় কাজ চালিয়ে যাওয়া চাই। কারণ কাজে সাহায্য ও সফলতার জন্য তো আল্লাহ তাআলাই রয়েছেন। তিনি আমাদের সর্বোত্তম অভিভাবক।
    আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
    إن الله يلوم على العجز ولكن عليك بالكيس فإذا غلبك أمر فقل حسبي الله ونعم الوكيل.
    “ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কাজে অক্ষমতা পকাশ করাকে আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন। এজন্য তোমাকে ‘কাইস’ كيس বা কর্মন্যতা অর্জন করতে হবে। আর যখন অনভিপ্রেত কিছু ঘটে যায় তখন নৈরাশ্য প্রকাশ না করে বলবে حسبي الله ونعم الوكيل (আবু দাউদ ঃ ৫/১১)
    অর্থৎ কোন ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে কিংবা কোন সমস্যা দেখা দিলে মোটেই হতাশ হবে না, বরং আল্লাহর অনুগ্রহের উপর ভরসা করে মনকে এ বলে সান্তনা দিবে যে, “আল্লাহই আমার উত্তম অভিভাবক, তিনিই আমার সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট। “অতঃপর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নব উদ্দীপনায় সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকবে।
    উপরোক্ত হাদীসে ‘অক্ষমতার’ বিপরীতে ‘কর্মণ্যতা’ বুঝাতে ‘কাইস’ كيس শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আভিধানিকভাবে শব্দটি ক্ষিপ্রতা, মেধার প্রখরতা, সক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা, প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। সে হিসাবে হাদীসের অর্থ দাঁড়ায়, তোমার কর্তব্য হলো কাজে-কর্মে উৎসাহী, ক্ষিপ্র হবে, তখন মনকে এই বলে সান্তনা দিবে যে, “আল্লাহই সর্বোত্তম অভিভাবক এবং তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট”। হীনমন্য হয়ে পিছু হটবে না, বরং সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হবে এবং নিজের জ্ঞান বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবে।
  • ছয়. হতাশা ও হতাশাবদীদের থেকে দূরে থাকাআমাদেরকে অবশ্যই হতাশা ও হতাশাবাদীদের থেকে দূরে থাকতে হবে। আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে যে, ভবিষ্যত একমাত্র ইসলামেরই। এটাই আল্লাহর অঙ্গীকার। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্যা হাদীসে আল্লাহর এ অঙ্গীকার তথা ইসলামের বিজয়ের সু-সংবাদ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। মুসলিমদের বর্তমান অবস্থাও প্রমাণ করছে যে, সেই শুভক্ষণ সন্নিকটে। তারা অতি দ্রুত সেই সোনালী যুগের দিকে প্রত্যাবর্তন করছে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন ঃوَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًاوَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا“তোমাদের মধ্যে যারা আমার উপর ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করবেন, যেমন তিনি শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে- যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন। ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকেও শরীক করবে না। (সূরা নূর ঃ ৫৫)উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের হাতে পৃথিবীর শাসনভার অর্পণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তবে শর্তারোপ করেছেন ঈমান ও সৎ-কর্মপরায়নতার। কাজেই এ শর্ত দু’টি পূরণ না করলে উক্ত শুভ সংবাদের অধিকারী হওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বানী করেছেন ঃ
    لا تقوم الساعة حتى يقاتل المسلمون اليهود فيقاتلهم المسلمون حتى يختبئ اليهودي من وراء الحجر، فيقول الحجر أو الشجر يا مسلم، يا عبد الله، هذا يهودي خلفى فتعال فاقتله إلا الغرقد فإنه من شجر اليهود.
    “কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মুসিলমরা ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করবে। মুসলিমরা এত বীর-বিক্রমে লড়াই করবে যে, ইয়াহুদীরা পালিয়ে পাথর ও বৃক্ষের আড়ালে আশ্রয় নিবে। আর তখন পাথর ও বৃক্ষ চিৎকার করে বলবে ঃ হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা! এই দেখ, আমার পিছনে ইয়াহুদী! এসো, এদের হত্যা কর! কিন্তু ‘গারক্বাদ’ غرقد বৃক্ষ এমন আহ্বান জানাবে না। কারণ এটি ইয়াহুদীরেদ গাছ। (মুসলিম ঃ ২/৩৯৬)
    এটা সুস্পষ্ট যে, এ হাদীসে বর্ণিত সময়কাল এখনও অতিবাহিত হয়নি। তাই বলছি, ভবিষ্যত একমাত্র আমাদের। সাওবান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ
    إن الله زوى لى الأرض فرأيت مشارقها ومغاربها وإن أمتى سيبلغ ملكها ما زوى لى منها.. الحديث.
    “আল্লাহ কিছুক্ষণের জন্য আমার সম্মুখে গোটা পৃথিবীকে সংকুচিত করে উপস্থিত করে, তখন আমি পৃথিবীর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য অবলোকন করি। আমার দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে ততদূর পর্যন্ত অবশ্যই আমার উম্মতের শাসন কর্তৃত্ব বিস্তৃতি লাভ করবে… (মুসলিম : ২/৩৯০)
    এ হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, অচিরেই মুসলিম উম্মাহর কর্তৃত্ব সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তৃতি লাভ করবে। কেননা বর্ণিত হাদীসে “যতদূর” বলতে সমগ্র পৃথিবীকে বুঝানো হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবী মুসলিমদের করতলে আসেনি। সুতরাং আমরা দৃঢ় চিত্তে বলতে পারি যে, নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে মুসলিমদের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করবে, ইনশাআল্লাহ। অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ
    ليبلغن هذا الأمر ما بلغ الليل والنهار ولا يترك الله بيت مدر ولا وبر إلا أدخله الله هذا الدين بعز عزيز أن بذل ذليل عزا يعزالله به الإسلام زذلا يذل به الكفر.
    “দিন রাতের আবর্তন যে পর্যন্ত রয়েছে, ইসলাম ধর্ম সে পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করবে। কাঁচা-পাকা কোন ঘরই অবশিষ্ট থাকবে না। সম্মানিতকে সম্মান দিয়ে আর অপদস্তকে অপমানিত করে এ দ্বীনকে আল্লাহ তাআলা সর্বত্রই প্রতিষ্ঠা করবেন। ইসলামকে করবেন সম্মানিত, আর কুফরকে করবেন লাঞ্ছিত। (মুসনাদে আহমদ ঃ ৪/১০৩) হাদিসটি মুহাদ্দিস ইবনে হাব্বান বর্ণনা করেন এবং শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
    অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ
    تكون النبوة فيكم ما شاء الله ان تكون ثم يرفعها الله إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، فتكون ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون ملكا عاضا فتكون ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها، ثم تكون ملكا جبريا فتكون ما شاء الله أن تكون، ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون خلافة على منهاج النبوة، ثم سكت.
    “নবুওয়াত ব্যবস্থা তোমাদের মাঝে ততদিন থাকবে, যতদিন আল্লাহ তাআলা মঞ্জুর করেন। অতঃপর যখন ইচ্ছা, তখন তিনি তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর তোমাদের মাঝে নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে এবং তা আল্লাহ তাআলা যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। অতঃপর তিনি তা উঠিয়ে নিবেন। তারপর হানাহানির রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা আল্লাহ তাআলার যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছায় তার বিলুপ্তি ঘটবে। তারপর জবর দখল তথা আধিপত্য বিস্তারের রাজত্ব কায়েম হবে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় দুনিয়াতে কিছুকাল বিরাজমান থাকবে। তারপর যখন আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, তখন এরও অবসান ঘটবে। অতঃপর নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত রাষ্ট্র-ব্যবস্থা কায়েম হবে। এ বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ রইলেন। (মুসনাদে আহমদঃ ৪/২৭৩)
    ثم تكون الخلافة على منهاج النبوة অতঃপর নবুওয়াতের পদ্ধতিতে খেলাফত ব্যবস্থা কায়েম হবে- মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তিই প্রমাণ করে সারা বিশ্বে ইসলামী শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে। রাজত্বের লাগাম মুসলিমদের হস্তগত হবে। কখনো এর ব্যতিক্রম হবে না। কারণ, বিভিন্ন বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা যথা সময়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে। যেমন এক হাদীসে আবি কাবিল (রহ.) বলেন ঃ
    كنا عند عبد الله بن عمر وبن العاص وسئل أي المدينتين تفتح أولا الفسطنطينية ام رومية، فدعى عبد الله بينما نحن حول رسول الله صلى الله عليه وسلم نكتب إذ سئل رسو الله صلى الله عليه وسلم أي المدينتين تفتح أولا القسطنطينية أم رومية، فقال الرسول صلى الله عليه وسلم مدينة هرقل أولا ـ يعنى الفسطنطينية.
    “একদা আমরা আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস রা. এর সাথে উপবিষ্ট ছিলাম। জনৈক ব্যক্তি পশ্ন করল, কোন শহর সর্বপ্রথম বিজিত হবে, কন্সটান্টিনোপল না রোম? আব্দুল্লাহ রা. একটি কড়া বিশিষ্ট বাক্স উপস্থিত করলেন এবং তা থেকে একখানা লিখিত পত্র বের করে বললেন, একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে লিখছিলাম। ইতিমধ্যে প্রশ্ন করা হল, সর্ব প্রথম কোন শহর বিজয় হবে, কন্সটান্টিনোপল না রোম? জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেব, সর্ব প্রথম হিরাক্লিয়াসের রাজ্য (কন্সটান্টিনোপল) বিজিত হবে। (মুসনাদে আহমাদ, ২/১৭৬)
    এ হাদীস ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র. রেওয়াতে করেন এবং শায়খ আলবানী রহ. বিশুদ্ধ বলে মত ব্যক্ত করেন। এই হাদীসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী পরিবর্তিতে হুবহু বাস্তবায়িত হয়েছে। সুতরাং অন্যান্য বিষয়ে তাঁর প্রদত্ত সকল ভবিষ্যদ্বাণী চিরসত্য হিসাবে প্রমাণিত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এটাই আমাদের ঈমান ও একীন।

একটি সন্দেহের নিরসন

দুর্বল ঈমানের এক শেণীর মুসলিমের ধারণা পৃথিবীতে আর কখনো পুর্ণাঙ্গ ইসলামী শাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেই যা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা নিজেদের এ সংশয় ও ভুল ধারণার স্বপক্ষে পবিত্র কুরআানের এ আয়াত পেশ করেন ঃ
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ .
“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।” (সূরা তাওবা : ৩৩)
উপরোক্ত শ্রেণীর লোকদের মতে এ আয়াতের উদ্যেশ্য ও প্রতিশ্র“তি ইসলামী খেলাফত কায়েম সম্পন্ন হয়ে গেছে। আর কখনও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
এদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এ ধারণার অসারতা প্রমানের জন্য আয়েশা রা. এর এই হাদীসটিই যথেষ্ট যে-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يذهب الليل والنهار حتى تعبد اللات والعزي فقالت عائشة: يا رسول الله إن كنت لاظن حين أنزل الله (هوالذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهره على الدين كله ولو كره المشركون) إن ذالك تماـ أى ان ذلك قد تم قال إنه سيكون من ذلك ما شاء الله … الحديث.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দিবা রাত্রির অবসান ঘটবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় ‘লাত’ উজ্জার পুজা করা না হবে। (আয়েশা (রা.) আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ। সূরায়ে তাওবার এ আয়াত ঃ هوالذي أرسل رسوله بالهدى ودين الحق নাযিল হওয়ার পর মনে করতাম এ আয়াতের প্রতিশ্র“ত ইসলামের বিজয় সম্পন্ন হয়েছে, আর কখনো এর পরিবর্তন হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ঃ এমন নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছায় এর পরিবর্তন ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ ঃ ৫/২৭৮)
অর্থাৎ এক সময় কুফর শিরকের প্রভাব বিস্তার লাভ করবে। তারপর আবারো ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার মাধ্যমে উক্ত আয়াতের পুনঃ বাস্তবায়ন ঘটবে। এ হাদীসটি এ কথার জ্বলন্ত প্রমাণ যে, সংশয়বাদীদের সংশয় ভিত্তিহীন ও অমূলক। পৃথিবীতে আবারো ইসলামের বিজয় হবে। মুসলিমদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনই প্রমাণ করে যে, অচিরেই বিশ্বে খালেস ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, সুতরাং সংশয়ের কোন কারণ নেই।
সময় সংকীর্ণ, নতুবা আমি এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করতাম যে, বর্তমান পরিস্থিতির আলোকেও বুঝা যায়- ভবিষ্যত কেবল ইসলামরেই। আমরা আশাবাদী যে, অচিরেই উম্মতের উপর আল্লাহর নুসরাত নাযিল হবে। আল্লাহর দরবারে আমাদের আকুতি, তিনি যেন আমাদেরকে হতাশা ও হতাশাবাদীদের থেকে দূরে রাখেন এবং আমাদেরকে দৃঢ় মনোবলের অধিকারীদের অন্তর্ভূক্ত করেন, যে মনোবল আমাদেরকে সম্মুখপানে এগিয়ে নিবে, কখনো পিছপা হতে দিবেনা। আমীন!
سبحانك اللهم وبحمدك أشهد ان لا إله إلا أنت استغفرك وأتوب إليك وصلى الله على نبينا محمد وعلى إله وصحبه وسلم.